সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা

ঈদের পর গত কয়েকদিনে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ এবং ভারতীয় নাগরিকদের হাতে অন্তত ৩ জন বাংলাদেশী নাগরিক নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন এবং আরো কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়। গতকাল পত্রিকায় প্রকাশিত একাধিক রিপোর্টে কুড়িগ্রাম জেলার পাটগ্রাম সীমান্তে বাংলাদেশী এক যুবককে ধরে নিয়ে লোহার খাঁচায় পুরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা ও গুরুতর আহত করার চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা যায়। আরেক যুবক গুরুতর আহত অবস্থায় বেঁচে আছেন। একই সময়ে শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতি উপজেলার রাংটিয়া গ্রামের স্কুল পড়–য়া দুই কিশোর হেমন্ত কোচ (১৪) এবং শীতল কোঁচ সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্য মেঘালয়ের সমেশচুড়া গ্রামে গেলে স্থানীয় অধিবাসীদের গণপিটুনীর শিকার হয়ে নির্মমভাবে নিহত হয়েছে। একই সময়ে এসব অস্বাভাবিক মৃত্যু পুরো জাতিকে হতবাক ও ক্ষুব্ধ করেছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু, দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন ও সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যে সব পদক্ষেপ চলছে এ ধরনের হত্যাকা-ে সে সবই তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ছে। সীমান্তে বিএসএফ’র এরকম অব্যাহত হত্যাকা- বাংলাদেশের জনগণের প্রতি ভারতীয় পক্ষের বৈরিতা ও বিশ্বাসঘাতকতারই সামিল।
পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় জাতিগত সম্পর্কের ইস্যুগুলো শুধু সরকারী পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়। সরকারের নীতিগত অবস্থানের পাশাপাশি দেশসমূহের নাগরিক সমাজ তথা সাধারণ জনগণের মধ্যে আন্তরিক যোগাযোগ ও সৌহার্দ্যরে মধ্য দিয়ে নতুন সম্পর্কের ক্ষেত্র তৈরী হতে দেখা যায়। ভারতের উত্তর-পূর্বাংশ এবং বাংলাদেশ একই ঐতিহাসিক, ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মেলবন্ধনের উত্তরাধিকারের অংশীদার হলেও সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যার মধ্য দিয়ে অনাস্থা ও অবিশ্বাসের সংকট তৈরী করা হয়েছে। দশকের পর দশক ধরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)’র হাতে বাংলাদেশী নাগরিকরা হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। একদিকে বিএসএফ সীমান্তে ভারতীয় ফেন্সিডিল ও মাদক চোরাচালানীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে, অন্যদিকে সীমান্তবর্তী গ্রামের নিরীহ সাধারণ নাগরিকদের উপর অযথা গুলিবর্ষণ ও অপহরণ করে নির্যাতন করছে। ২০১১ সালের জানুয়ারীতে বিএসএফ’র গুলিতে নিহত হয়ে সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে থাকা বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানীর লাশ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের এক নতুন আইকন হয়ে উঠেছে। পাটগ্রাম সীমান্তে বিএসএফ’র হাতে বাংলাদেশী যুবক হত্যা এবং মেঘালয়ে ভারতীয় নাগরিকদের হাতে বাংলাদেশী দুই কিশোর হত্যার ঘটনা এমন সময়ে সংঘটিত হলো যখন ভারতে ফেলানী হত্যার বিচার শুরু হয়েছে।

গত ১৩ আগস্ট মঙ্গলবার ফেলানী হত্যাকা-ের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর এ বিচারের মধ্য দিয়ে সীমান্তে বিএসএফ’র হাতে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধ হবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যেই সোমবার এবং মঙ্গলবার সীমান্তে ভারতীয়দের হাতে অন্তত ৩ জন বাংলাদেশী নাগরিক নির্মমভাবে নিহত হলেন। ইতিপূর্বেও বিভিন্ন সময়ে দ্বি-পাক্ষিক বৈঠকের সময়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আশ্বাস ও আশাবাদ প্রকাশের পরও সীমান্তে বিএসএফ’র হত্যাকা- মোটেও কমেনি। বিএসএফ প্রধান, এমনকি ভারত সরকারের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের আশ্বাসের পরও হত্যাকা- বন্ধ হয়নি। বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তানসহ আরো অন্তত: ৫টি দেশের সাথে ভারতের সীমান্ত রয়েছে, অন্যকোন দেশের নাগরিকদের উপর বিএসএফ’র এভাবে গুলিবষর্ণের নজির নেই। ভারত ও বাংলাদেশে বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সরকারের মধ্যে সুসম্পর্কের ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার একতরফা অনেক ছাড় দিয়েও ভারতের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সীমান্তে বিএসএফ’র আচরণে এর কোন প্রভাব দেখা যায়নি। গত জুনে প্রকাশিত বিজিবি’র এক পরিসংখ্যান থেকে সাড়ে ৪ বছরে বিএসএফ’র গুলিতে অন্তত: ২১৪ জন বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হওয়ার তথ্য জানা যায়। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কোন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত হাই প্রোফাইল বৈঠক ও সম্মেলনে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আশ্বাস ও নিশ্চয়তা সত্ত্বেও সীমান্তে হত্যাকা- বন্ধ না হওয়ার পেছনে বাংলাদেশের নতজানু পররাষ্ট্রনীতিকেই দায়ী করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। বিজিবি’র প্রতিবাদ বা বারবার পতাকা বৈঠক করেও কোন কাজ হচ্ছে না। প্রতিবেশী দেশের সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে দেশের নাগরিকদের প্রতিদিনই এভাবে হতাহত হওয়ার ঘটনার কঠোর প্রতিবাদ জানাতে হবে সরকারকে। এসব হত্যাকা-ের বিচার ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি এ ধরনের হত্যাকা- বন্ধে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ত্যাগ করে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি হত্যাকা-ের পরবর্তী বিষয়াদি ও জনগণকে যথাসময়ে অবহিত করতে হবে।

Comments

Popular posts from this blog

সবচেয়ে বড় জাহাজ গুলো

কিছু অবিশ্বাস্য ও কাল্পনিক ছবি