তিব্বত! তিব্বত!

তিব্বত, সে এক অবাক করা নাম, জাদুময় ভূখণ্ড, যার তুলনা কেবলমাত্র সে নিজেই! হাজার হাজার কিলোমিটার চলে যাওয়া ঊষর, রূক্ষ, পাথুরে ভূমি, পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গগুলোকে বুকে রাখা বিশ্বের সর্বোচ্চ মালভূমি আর বরফগলা নদীর সমন্বয়ে গঠিত তিব্বতের জুড়ি আক্ষরিক অর্থেই আমাদের গ্রহে দ্বিতীয়টি নেই। যেমন বিচিত্র এর ভূপ্রকৃতি তেমন বিস্ময় জাগানিয়া এর প্রাণীকুল আর এখানে বসবাসরত মানব সম্প্রদায়।
IMG_0281

DSC00629এই শতকেও সেখানে মেনে চলা হয় শতাব্দী প্রাচীন রীতিনীতি, রহস্যে মোড়া গুম্ফাগুলোর দেয়ালে প্রতিধ্বনি তোলে পুরোহিতের মন্ত্র, ক্যানভাসে দক্ষ হাতে একের পর এক নয়নজুড়ানো নিপুণ থাংকা (পটচিত্র) এঁকে যায় গেরুয়া রঙের পোশাক মোড়া সন্ন্যাসী চিত্রকরেরা, সাধারণ মানুষ ফিরে যেতে চায় যাযাবরবৃত্তিতে, পশুচারণের আদিম পেশায়। সেই সাথে হাজার বছর ধরেই তিব্বত এক নিষিদ্ধ বিস্ময় বহির্বিশ্বের কাছে, কারণ বিদেশীদের অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ছিল দীর্ঘ দিন, আজো তা নানা নিয়ম-কানুন-শৃঙ্খলার নিগড়ে ঘেরা।
DSC00777

ছোটবেলায় সাধারণ জ্ঞানের বইতে দেখতাম নিষিদ্ধ দেশ- তিব্বত, নিষিদ্ধ নগরী- তিব্বতের রাজধানী লাসা, সেইসব নামগুলো যেন ফেনিয়ে ওঠা গাঢ় রহস্যের কুয়াশায় ঘেরা, আলো- আঁধারে ঢাকা, খুব জানতে ইচ্ছে করত তাদের সম্পর্কে, কিন্তু জানবার উপায় ছিল না বললেই চলে। নানান বইপত্র ঘেঁটে জানতে পারি ব্রহ্মপুত্র নদীর উৎপত্তিস্থল অপরূপা মানস সরোবর সেই নিষিদ্ধ মালভূমির অবিশ্বাস্য উচ্চতায় অবস্থিত, তার সঙ্গী পবিত্র নয়নাভিরাম পর্বত কৈলাস, যাকে তিব্বতিরা মনে করে বিশ্বের কেন্দ্রস্থল। বৌদ্ধ ও হিন্দু, দুই ধর্মের অনুসারীদের কাছেই কৈলাস তীর্থক্ষেত্র, অতি পবিত্র এই পর্বতে আরোহণের চেষ্টাকারীকে মৃত্যুদন্ড দেবার বিধান রয়েছে স্থানীয় আইনে, কাজেই সেখানে না হলেও তিব্বতি বৌদ্ধদের কাছে হাজার বছর ধরে অতি পবিত্র বিবেচিত নীলকান্তমণিদেবী বা টেঁকো ঈশ্বর বলে পরিচিত প্রায় সাতাশ হাজার ফুট উচ্চতার (২৬,৯০৬ ফুট বা ৮,২০১ মিটার, আমাদের গ্রহের ষষ্ঠ উচ্চতম পর্বত) চৌ য়ূ পর্বত শৃঙ্গ ।

   হিমালয় থেকে বয়ে আসা বটেকোশী নদীর উপরে নির্মিত এক সেতু সংযোগ করেছে এই দুই দেশকে, সেদিকে এক পলক পড়তেই যেন ধনী-গরীবের অর্থনৈতিক পার্থক্যটা প্রকট হয়ে ধরা দিল খালি চোখেই, নেপালের সীমানায় কোনমতে দাড় করানো কয়েকটা ভবন, অনেকটা ছাপরা ধরনের কিছু খাবার দোকান, জনা কয়েক পুলিশ- এই শেষ! অন্যদিকে তিব্বত সীমান্তের ভিতরে চীনা মিলিটারির প্রায় দুর্ভেদ্য দুর্গ, সারি সারি ভবন, সর্বদাই টহলরত অস্ত্রধারী মিলিটারি। সর্বক্ষণের কড়া পাহারা যেন দর্শনার্থীদের কেউ সীমান্তবর্তী কোন স্থাপনা বিশেষ করে সেতুটার ছবি তুলতে না পারে।
DSC06135
কাছের দেশ মানজ্বালা (বাংলাদেশের চীনে নাম) থেকে আসলেও ভিসার ঝামেলা শেষ করতে বেশ খানিকক্ষণ লেগে গেল, উল্লেখ্য ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকের জন্য গত দুই বছর ধরেই চীন সরকার যে কোনরকম রাজনৈতিক গোলযোগ এড়ানোর জন্য তিব্বতে কোনরকম পর্বতাভিযান চালানোর অনুমতি দেয় নি। কাস্টমসের গোমড়ামুখো চীনা পুলিশ কর্মকর্তার মূল আকর্ষণ ছিল সাথে বয়ে আনা চারখানা বই, সেগুলো কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত কিংবা দালাই লামার বাণী সম্বলিত কিনা তা বোঝার জন্য যেন রীতিমত যুদ্ধ অভিযান চলল পাতার পর পাতা উল্টে, তবে আমার নিরেট মাথায় কিছুতেই ঢুকল না কেন সেই উচ্চশিক্ষিত সরকারী কর্মচারীরা আমার প্রতিটি ইংরেজি বই উল্টো করে ধরে যাচাই করলেন! সেই সাথে প্রত্যেকের ব্যাগে চলল চিরুনি তল্লাসি, আমরা পার পেয়ে গেলেও এক ব্রাজিলীয় পর্যটকের ব্যাগে মিলল তিব্বতের পতাকা, সাথে সাথে ভিসা থাকা স্বত্বেও প্রবেশাধিকার বাতিল হয়ে গেল তার! অন্যদের মুখে শুনলাম কারো সাথে মাও সে তুং বিরোধী কোন বই বা লিফলেট এমনকি দালাই লামার ছবি থাকলেও তার কপালে একই পরিণতি ঘটত।
IMG_0157
সব জায়গাতেই তিব্বতি মহিলাদের কর্ম তৎপরতা চোখে পড়ার মত, মিষ্টি হেসে তারা সম্বোধনের ভঙ্গীতে দুহাত জোড় করে বলে থাসিডেলি- তিব্বতি ভাষায় নমস্তে।
IMG_0177
DSC00783
খানিক বিশ্রামের পরপরই গাড়ী করে দারুণ পিচ ঢালা রাস্তায় ৩৬৩০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত ক্ষুদে জনপদ নায়লাম-এ আগমন। রাস্তাটির অতি অল্প অংশ তখনো নির্মাণাধীন থাকলেও কেবল মনে হচ্ছিল এই দুর্গম বন্ধুর এলাকায় হিমালয়ের বুক চিরে কি করে চীনে প্রকৌশলীরা এই বিস্ময়কর পথ নির্মাণ করেই ছাড়ল!

DSC00638DSC00630তিব্বতিদের আলু ক্ষেত, ইয়াকের সাহায্যে লাঙ্গল টানা,
DSC00641


DSC00686যাযাবর পশুপালকদের আস্তানা, ভেড়া- ছাগলের পাল গণনা করে কাঠমান্ডুর পুঁজোর জন্য প্রস্তুত করা। ভেড়া গণনার  এক থেকে দশ পর্যন্ত প্রতিটি সংখ্যার উচ্চারণ তিব্বতি ও বাংলায় হুবহু এক!

IMG_0148
এত উঁচুতে কি শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে গিরিরাজ অপেক্ষমাণ, দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে বটেকোশী নদী দেখা যায়, চারদিকে সবুজে ছাওয়া পর্বতমালা, আরো দূরে তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গ।
DSC00778

DSC00625
ক্রীড়ারত তিব্বতি শিশু, ইয়াকের মাংস নিয়ে খোলা জায়গায় কসাইয়ের দোকান, অতি সুসজ্জিত চাইনীজ মিলিটারির অফিস।
DSC00600

IMG_0431
 মূল্যবান আবিস্কার- চৈনিক ভূখণ্ডে ফেসবুক নামক বস্তুটিতে প্রবেশ সম্ভব নহে! এই শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় সব ব্যবসার মালিকই তিব্বতে গত কয়েক দশকে আসা হান চাইনিজরা। এই কি স্বপ্নের তিব্বত, যেখানে যন্ত্র সভ্যতাতেই অভ্যস্ত সবাই, অধিকাংশ স্থানীয় শিশুর গায়ে ধুলোধূসরিত মলিন পোশাক, কাক ভোরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর ভরাট কণ্ঠের ওম মণি পদ্মে হুম মন্ত্রের বদলে ঘুম ভেঙ্গে যায় মিলিটারি মার্চপাস্টের উৎকট চিৎকারে!

মাইলের পর মাইল রূক্ষ, ঊষর, আপাতদৃষ্টিতে প্রাণহীন, অনুর্বর তিব্বতের মালভূমি, পর্বত আর উপত্যকার সমন্বয়ে গঠিত অদ্বিতীয় ভূপ্রকৃতি, এর মাঝে চড়াই-উৎরাই, মালভূমি, উপত্যকা, নদী এমনকি বরফাচ্ছাদিত পর্বত শিখর প্রায় অতিক্রম করে চলে গেছে মানুষের তৈরি উচ্চতম সড়ক, এত মসৃণ সে রাস্তা, এমন নিপুণ দক্ষতায় এর সমাপ্তি টানা হয়েছে যে মাখনের তৈরি বলে ভ্রম হয়, আর চলে গেছে এই গ্রহের বন্ধুরতম জায়গার মাঝ দিয়ে! বেইজিং অলিম্পিকের জন্য মাউন্ট এভারেস্টের বেসক্যাম্প পর্যন্ত এই পিচ ঢালা পথ নিয়ে যাবার মহাপরিকল্পনা হাতে নেয় সে দেশের সরকার, অবধারিত ভাবেই নামমাত্র সন্মানিতে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহৃত হয় দরিদ্র তিব্বতিরা।
IMG_0234
পথে মনের পর্দায় রূপকথার আমেজ ছড়ানো তিব্বতি গ্রামগুলো দর্শন দিতে লাগল একে একে, কোন কোন গ্রামের উঁচু জায়গায় বৌদ্ধমন্দির, অনেক গ্রামেই বিদ্যুতের জন্য সোলার প্যানেলের চল দেখা গেল। ইয়াক, ভেড়া, পার্বত্য ছাগল, টাট্টু ঘোড়ার পাল নিয়ে ব্যতিব্যস্ত পশুপালক ও তাদের রাস্তা জুড়ে অবরোধ করে থাকা পশুর পাল।
IMG_0219
বিচিত্র সেই রাখালদের বেশভূষা, লম্বা কালো চুল নানা বিচিত্র ভাবে বিন্যাস করা, কারো কারো এক কানে বিশাল মাকড়ি, মাথায় টুপি, এককালের রঙচঙে কাপড় বহু ব্যবহারে বিবর্ণ। অনেক শিশুও চারণ কাজে নিয়োজিত থাকে।
IMG_0229

IMG_0233IMG_0316IMG_0304IMG_0191IMG_0196
নয়নমনোহর এদের বাড়ীগুলো, অধিকাংশই সাদারঙের হলেও জানালগুলো নানা রঙে ঝলমল, সেই সাথে বাড়ীর দেয়ালের উপরে ইয়াকের ঘুঁটে শুকাবার প্রচেষ্টা। প্রতিটি লোকালয়েই একদল কুকুর সদা প্রহরারত, বিশালাকৃতির রোমশ কুকুরগুলো স্থানীয়দের চোখের মণি।

IMG_0237

প্রায় ৫০০০ মিটার উচ্চতায় এক প্রায় সমতল জায়গায়, উদ্দেশ্য বিশ্বের ১৪তম উচ্চ পর্বতশৃঙ্গ সিসাপাংমাকে অবলোকন । ৮০০০ মিটারের অধিক উচ্চতা বিশিষ্ট ( পৃথিবীতে এমন পর্বতশৃঙ্গ আছে মাত্র ১৪ টা, সবই হিমালয়ে) ধবধবে সাদা বরফাচ্ছাদিত সিসাপাংমা দাড়িয়ে আছে দিগন্তকে আড়াল করে, অন্যপাশে আরেক বিখ্যাত শৃঙ্গ গৌরিশঙ্কর।


DSC00702এর পরে আবার ঢাল বেয়ে নিচের পানে, দর্শন মেলে চৌ য়ূ এবং পর্বতাধিপতি চো মু লাংমার ( এভারেস্টের তিব্বতি নাম)।
IMG_0367
 তিব্বতের সেই অপার্থিব ভয়ংকর সৌন্দর্যময় ঊষরভূমি, হয়তো এতটা রূক্ষ বলেই তিব্বতের আকর্ষণ পর্যটকদের কাছে এতো অলঙ্ঘনীয়, অমোঘ, হাজার বছর ধরে সে আছে ভ্রমণপিপাসুদের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে!
IMG_0341
সেই সাথে এত ভুললেও চলবে না যে কারণে পলিমাটি দিয়ে তৈরি আমাদের সুজলা সুফলা বাংলাদেশ যে কারণে এত উর্বর, সেই একই কারণে তিব্বত এত মরুময়, শুষ্ক! কারণটা, গিরিরাজ হিমালয়। এক বিশাল প্রাচীরের মত সীমানা আগলে দাড়িয়ে আছে তা, বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্পপূর্ণ মেঘ কোনমতেই সেই সুউচ্চ বাঁধা ডিঙ্গাতে পারে না, ফলশ্রুতিতে জীবনদায়ী বৃষ্টিপাত একতরফা ভাবে সবসময়ই পক্ষপাতিত্ব করে আমাদের দিকটাতে, গড়ে তোলে উর্বর ভূমি আর হিমালয় প্রাচীরের অন্য পাশে তিব্বত থেকে মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা থাকে শুষ্ক, রিক্ত।
IMG_0259
 গোটা পঞ্চাশেক বাড়ী আর হোটেলের এক ক্ষুদে জনপদ তিংরি, উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪২০০ মিটার, পশ্চিমে শত শত মাইল চলে গেছে তিব্বতের রূক্ষ মালভূমি আর পূর্ব দিগন্তে দৃষ্টি যাবার অনেক অনেক আগেই তা আটকে পড়ে সমগ্র বিশ্ব থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করা মাউন্ট এভারেস্টে!
''
তিংরির হোটেলের যে সদা তৎপর দিদিমা পাহারাদার থেকে শুরু করে হেসেলদারের কাজ পর্যন্ত করতেন তার শতভাজ পড়া মুখের রেখাগুলো বলে দেয় শতবর্ষের প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছেন এই কর্মঠ মহিলা। হিমালয়ের অধিবাসীদের মাঝে- অদম্য প্রাণশক্তি, নির্মেদ শরীর, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রমরত।  অনেকের হাতেই একমাত্র সম্বল জপমালা বা জপযন্ত্র।
IMG_0447
তবে তিতিবিরক্ত হয় সেখানকার খাবারে, তিব্বতিদের প্রধান খাবার চমবা( গম ও যবের সমন্বয়ে তৈরি), আর মাত্রাতিরিক্ত তেলে ভাজা সবজি, ডিম, কখনো ইয়াকের মাংস।
IMG_0162
 তিংরি বাজারে অবস্থিত এক নামকাওয়াস্তে নেপালি রেস্তোরাঁ অকূল পাথারে শেষ ভরসা। সেখানকার বাজারগুলোতে যেন ধুলো সবসময় থৈ থৈ করছে, কসাইয়ের দোকানে ঝোলানো ভেড়া বা ইয়াকের মাংসে ধুলোর পুরু আস্তরণ, তিব্বতিদের শরীরেও তাই, এমনিতেই আবার তাদের নামে দুর্নাম আছে স্নান থেকে যতদূর সম্ভব দূরে থাকার।

DSC00706
স্থানীয়রা অনেকেই ছবি তুললে টাকা দাবি করে।
IMG_0204IMG_0276DSC00628
IMG_0533
 
১৯৪৯ সালে তিব্বতে ছয় হাজারের উপর বৌদ্ধ মন্দির থাকলেও এখন হাতে গোনা।
IMG_0538

IMG_0539

DSC00707




270572_10150711421680497_608590496_19782627_6929667_n

Comments

Popular posts from this blog

সবচেয়ে বড় জাহাজ গুলো

কিছু অবিশ্বাস্য ও কাল্পনিক ছবি